Monday, September 22, 2025

নিউইয়র্কে তীব্র উত্তেজনা

 প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফর ঘিরে একদিকে ক্ষোভ, অন্যদিকে অভিবাদন


জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গতকাল নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর আগমন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে।

বিএনপি তাঁকে স্বাগত জানাতে নানা আয়োজন করলেও আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে সর্বাত্মক বিক্ষোভের। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি-অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসে ইতোমধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

২১ সেপ্টেম্বর বিকালে ডাইভারসিটি প্লাজায় বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষে আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতা-কর্মী স্লোগান দিতে শুরু করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিএনপির আয়োজিত সমাবেশ শেষে আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপস্থিতিই সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়।

পরস্পরবিরোধী কর্মসূচিতে তটস্থ নিউইয়র্কের পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থাও। এমন অবস্থা দৃশ্যমান হয় ২১ সেপ্টেম্বর রবিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসের অলিগলিতে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের হাজারো নেতা-কর্মীর মধ্যে মারমুখো অবস্থা সামলাতে হিমশিম খায় পুলিশ। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অঘোষিত একটি বিষয় অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে যে তারা সহিংস হবেন না। নিজ নিজ বক্তব্য-স্লোগানের বাইরে আক্রমণাত্মক কোনো আচরণ না করতেও তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন।

ড. ইউনূসের সফর কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিমানবন্দর থেকে জাতিসংঘ সদর দপ্তর এবং তাঁর হোটেলের সামনেও কালো পতাকা প্রদর্শন ও বিক্ষোভের প্রস্তুতি চলছে। ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ড. ইউনূসের ভাষণ দেওয়ার দিন এবং পরদিন টাইমস স্কোয়ার এলাকাতেও বিক্ষোভ কর্মসূচির অনুমতি নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা স্লোগান তুলেছেন- ‘যেখানে ইউনূস, সেখানেই প্রতিরোধ।’

অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি সংগঠনগুলো বিমানবন্দর, হোটেল এবং জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে গণসংবর্ধনার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে প্রবাসে দুই দলের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কনস্যুলেট নিউইয়র্ক পুলিশ, মেয়র অফিস ও ফরেন সার্ভিসকে চিঠি দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার অনুরোধ জানিয়েছে। কনসাল জেনারেল মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক জানান, আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ কর্মসূচির তথ্য তাঁদের হাতে আছে এবং যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে তাঁরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুল লতিফ সম্রাট বলেন, ‘ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাঁকে স্বাগত জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’ অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান অভিযোগ করেন, ড. ইউনূসের সরকার দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস। জানা গেছে, তাঁর ভাষণে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সংস্কার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি, রোহিঙ্গাসংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন অর্থায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অঙ্গীকার তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেবেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নিতে ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, টেক্সাস, মিশিগান, ইলিনয়, বস্টন, ভার্জিনিয়া, ম্যারিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, নিউজার্সি, কানেকটিকাট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও নিউইয়র্কে এসেছেন বলে জানান দক্ষিণাঞ্চলীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম ফজলুর রহমান এবং সেক্রেটারি ডা. মুহম্মদ আলী মাণিক।

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা আবুল হাসিব মামুন, মহিউদ্দিন দেয়ান, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ চৌধুরী, সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলসহ নেতারা জেএফকে এয়ারপোর্টে বিক্ষোভ-সমাবেশের সার্বিক সমন্বয় করছেন বলে সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে। জেএফকে এয়ারপোর্টে মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি তুমুল বিক্ষোভের কর্মসূচি জেনে এয়ারপোর্ট প্রশাসন নিরাপত্তার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সবাইকে তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনে সহায়তা দেবে। তবে কেউ উচ্ছৃঙ্খল হলে শাস্তির আওতায় নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সফরসূচি অনুযায়ী, অধ্যাপক ইউনূস ২৬ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। এ ছাড়া তিনি একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। ভাষণে তিনি বিগত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারমূলক উদ্যোগ, ২০২৪ সালের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার তুলে ধরবেন।

সফরসঙ্গী হিসেবে ছয়জন রাজনৈতিক নেতা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রয়েছেন। তাঁরা হলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও জামায়াত নেতা নকিবুর রহমান তারেক এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা। বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, এ বছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির সভাপতিত্বে ‘হাই লেভেল কনফারেন্স অন দ্য সিচুয়েশন অব রোহিঙ্গা মুসলিম অ্যান্ড আদার মাইনোরিটিস ইন মিয়ানমার’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এটি জাতিসংঘে রোহিঙ্গাসংকট নিয়ে প্রথমবারের মতো এমন একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক বলে দাবি করা হচ্ছে। এই বৈঠক থেকে কার্যকর সমাধান উদ্ভাবনের জন্য গত মাসে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক অংশীদার ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক ইউনূসের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে, যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন পেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ২৫ সেপ্টেম্বর যুবকদের জন্য কর্মপরিকল্পনার ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেবেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরবেন। ভাষণে তিনি শান্তিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন, নিরাপদ অভিবাসন, অবৈধ অর্থ পাচার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়ও তুলে ধরবেন। সফরকালে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও কমনওয়েলথ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভা, পিসবিল্ডিং কমিশন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক, ‘জি-৭৭ ও চীন’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক, নারী-শান্তি ও নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট নেটওয়ার্ক, ওআইসি বার্ষিক সমন্বয় সভা, বিমসটেক, সিকা এবং এলডিসি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

Share:

0 comments:

Post a Comment

banner